নিয়ম নেই ফ্রি যাতায়াতের তবুও গণপরিবহণে একশ্রেণির পুলিশ সদস্যের এমন আচরণে চালক ও হেলপাররা অতিষ্ঠ

‘পুলিশ পাশ’ আছে, ভাড়া চাইবি না

Passenger Voice    |    ১২:৫৮ পিএম, ২০২২-০৯-২০


‘পুলিশ পাশ’ আছে, ভাড়া চাইবি না

‘পুলিশ পাশ’। কথাটি বাসের ভাড়া আদায়কারী, হেলপার/সুপারভাইজারদের কাছে খুবই পরিচিত। কিন্তু কেউ কোনোদিন এসব পাশের বিষয়ে কোনো নির্দেশনার কথা শোনেননি। এমনকি এই পাশ দেখার সুযোগও পাননি। অথচ পুলিশ পাশের নামে প্রতিদিন নগর পরিবহণে পুলিশ সদস্যদের অনেকে বিনা ভাড়ায় যাতায়াত করছেন। এর ফলে বাস মালিকরা বিপুল পরিমাণ বৈধ ভাড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া যেসব চালক-হেলপার চুক্তিতে ভাড়া নিয়ে বাস চালান, তাদের ক্ষতি আরও বেশি। কিন্তু নানা কারণে তারা কথিত এই ‘পুলিশ পাশ’ নিয়ে প্রতিবাদ করতে পারছেন না।এক অনুসন্ধানে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘পুলিশ পাশের নামে ভাড়া না দেওয়ার কোনো বিধান নেই। কেউ যদি এমন কাজ করেন, তা নৈতিকতাবিরোধী। অভিযোগ পেলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

যোগাযোগ করা হলে বিআরটিএ-এর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মাহবুব-ই-রাব্বানী রোববার বলেন, ‘পুলিশের ভাড়া না নেওয়ার বিষয়ে বিআরটিএ-এর কোনো নির্দেশনা নেই। তারপরও দিনের পর দিন চলছে এ অঘোষিত নিয়ম।’

কেস স্টাডি : বুধবার রাত সাড়ে ৯টা। প্রজাপতি পরিবহণের একটি বাসে খিলক্ষেত থেকে উঠেন একজন পুলিশ সদস্য। কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় পরিবহণটির একজন চেকার গাড়িতে যাত্রীর সংখ্যা গণনার জন্য ওঠেন। তিনি যখন গণনা শেষ করে ওয়েবিল প্রস্তুত করছিলেন, তখন একজন যাত্রী (পুলিশ সদস্য) হাত তুলে বলেন, ‘এই, একটা পুলিশ পাশ আছে।’ এরপর চেকার তাকে বাদ দিয়ে যাত্রীর হিসাব লিখে ওয়েবিল চূড়ান্ত করেন।

গাড়িটি যখন মিরপুরের ইসিবি চত্বরে পৌঁছে তখন কন্ডাকটর ভাড়া কাটতে কাটতে সিভিল পোশাকে থাকা ওই পুলিশ সদস্যের কাছে আসেন। ভাড়া চাইতেই তিনি ধমক দিয়ে বলেন, ব্যাটা চোখে দেখিস না। ‘পুলিশ পাশ’ আছে বলে তোর চেকারকে তখন বললাম। এ সময় কন্ডাকটর বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘ভুল হয়ে গেছে স্যার’। এরপর ভাড়া না নিয়ে তার কাছ থেকে চলে যান কন্ডাকটর।

এ সময় ওই বাসে প্রতিবেদক নিজেই যাত্রী ছিলেন। পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের কাছে তার নাম ও পদবি এবং কর্মস্থলের কথা জানতে চাইলে তিনি প্রথমে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। সাংবাদিক পরিচয় জানার পর তিনি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে বলেন, তিনি পুলিশের কনস্টেবল। তবে কোথায় কর্মরত আছেন, তা বলতে চাননি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে আমিও দেখে আসছি, ‘পুলিশ পাশ’ বললে পরিবহণ শ্রমিকরা ভাড়া নেয় না। তাই পুলিশ পাশ বলেই এভাবে যাওয়া-আসা করি।’ ওই পুলিশ সদস্য মিরপুর-১ নম্বরে নেমে যান। এরপর এ প্রতিবেদকের কাছে মুখ খোলেন ওই কন্ডাকটর। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন অন্তত তার বাসেই ২০ থেকে ২৫ জন বাসে উঠে ‘পুলিশ পাশ’ বলে ভাড়া দেয় না। তারা আসল পুলিশ নাকি নকল পুলিশ, তাও আমরা জানতে পারি না। কিছু বললে ধমক দেয়। ট্রাফিক সার্জেন্ট দিয়ে মামলা দেওয়ার ভয়ও দেখায়।’

শনিবার সকালে অছিম পরিবহণে যাতায়াতের সময় বাসটির হেলপার কামাল হোসেন বলেন, ‘পুলিশ পাশের যন্ত্রণায় আমরা রীতিমতো অতিষ্ঠ। দিনে না হলেও অন্তত ২০-২২ জন উঠে পুলিশ পাশ কাটায়। ছাত্রদের তো আইডি কার্ড দেখে আমরা হাফ ভাড়া নিই। কিন্তু পুলিশ পাশে এই সুযোগ নেই। তারপরও সিভিলে পুলিশ পাশ আছে বলে ভাড়া দেয় না। চাইলে নানাভাবে ভয় দেখায়। তাই ভয়ে আমরা পুলিশ পাশ দেখতেও যাই না। ভাড়া না নিয়ে এমনিতেই মাফ কইরা দিই।’ তিনি বলেন, ‘পোশাক পরা পুলিশের সঙ্গে তো কথাই বলা যায় না। সিভিল পোশাকে থাকা পুলিশ সদস্যদের কিছু বললে তারা সার্জেন্টের ভয় দেখায়। এজন্য হয়রানির ভয়ে আমরা কিছু বলি না।’

রোববার দুপুর ২টা। প্রতিবেদক বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পরিবহণের যাত্রী। প্রেস ক্লাব থেকে গন্তব্য বিশ্বরোড। শাহবাগ থেকে বাসটিতে উঠেন সাদা পোশাকে পুলিশের দুজন সদস্য। সাধারণ যাত্রী ভেবে ভাড়া চাইতে গেলে কন্ডাকটর বিপাকে পড়েন। তারা জানান ‘পুলিশ পাশ’ আছে। কোথায় নামবেন জানতে চাইলে কন্ডাকটরকে তারা ধমক দিয়ে বলেন, যেখানে নামার সেখানেই নামব। পরে জানান, তারা বিমানবন্দরে নামবেন।

এ সময় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পরিবহণের কন্ডাকটর জসিম উদ্দিন বলেন, ‘পুলিশ পাশের জ্বালায় আমরা রীতিমতো অতিষ্ঠ। প্রতিদিন না হলেও ১৫ থেকে ২০ জনকে পুলিশ পাশের নামে ফ্রি নিয়ে যেতে হয়। দিনে পুলিশ পাশের নামে যে ভাড়াটা খোয়া যায়, তা ভাবতে কলিজায় লাগে।’

এদিকে কদমতলী থেকে টঙ্গীগামী আকাশ পরিবহণের চালক আকরাম হোসেন মোবাইল ফোনে বলেন, ‘পুলিশ পাশের নামে ভাড়া না দেওয়া আসলে নতুন নয়। তবে ইদানীং পুলিশ পরিচয়ে বেশি লোকজন গাড়িতে ওঠে। তিনি জানান, আদৌ পুলিশ পাশের নিয়ম আছে কি না, তা তিনিও জানেন না।

আরেক পরিবহণচালক বলেন, ঢাকা শহরের বেশির ভাগ গাড়িই চুক্তিতে চলে। পুলিশ পাশের নামে দিনে কম করে হলেও বাসপ্রতি ৪-৫শ টাকার ভাড়া খোয়া যায়। এটি আসলে দুঃখজনক। তবে আমাদের তো রাস্তায় চলতে হয়। এ কারণে আমরাও কিছু বলি না।

মিরপুর-১২ নম্বর থেকে কালিয়াকৈরগামী রাজধানী পরিবহণের এক চালক বলেন, ‘ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ বেশি উঠেন না গাড়িতে। আর উঠলেও তাদের কেউ কেউ আবার নিজে থেকে ভাড়া দিয়ে দেন। তাছাড়া ডিউটি শেষে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ বাসে উঠেন। তারা স্বল্প দূরত্বে যান। ভাড়া না দিলেও অনেকে ভালো ব্যবহার করেন। মূলত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে আমাদের কোনো সমস্যা হয় না। অনেক সময় সিট ফাঁকা থাকলেও তারা বসতে চান না। দাঁড়িয়ে যান। অনেকে ভাড়াও দিতে চান। কিন্তু আমরা নিই না।’

একজন পরিবহণ মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কোনো নিয়মেই গণপরিবহণে পুলিশের জন্য ফ্রি পাশ নেই। কিন্তু আমরা বাধ্য হয়েই এ ব্যাপারে কিছু বলি না। কারণ রাস্তায় চলতে হয়। গাড়িতে ত্রুটিবিচ্যুতি থাকে। বুঝেনই তো’।

সূত্র: যুগান্তর


প্যা.ভ/ম